স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়লেও অপ্রতুল

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার জন্য দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনা প্রয়োজন। আমাদের স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দের টাকা দুর্নীতিতে অপচয় হয় বেশি। এই দুর্নীতি কমিয়ে বাজেটটাকে উপজেলাভিত্তিক বণ্টন করা হলে দেশের বেশির ভাগ মানুষ উপকৃত হবে, নয়তো দরিদ্ররা সেবা পাবে না এবং মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্তের পর্যায়ে চলে যাবে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে ২৩ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ পরিচালনায় ব্যয় ৯ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ব্যয় ৯ হাজার ৪০ কোটি টাকা। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ১২৮ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ধারা হয়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রস্তাবিত বাজেটের শতকরা ৫ ভাগ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ হয়েছিল ২০ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় এবার ২ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

গত ১০ বছরের বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে ১৭ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হলেও সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে ১৪ হাজার ৮২৯ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। যা ছিল মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে ১২ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হলেও সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়ে হয় ১৪ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন মিলিয়ে ১১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল। যা ছিল মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ খাতে মোট ৯ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল নয় হাজার ১৩০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা যা বাজেটের ৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, ২০১০-১১ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। টাকার অংকে যার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা।

বাজেট বরাদ্দ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন :

পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হক ইত্তেফাককে বলেন, এই বাজেট স্বাস্থ্য খাতের জন্যে অপ্রতুল। সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার জন্য দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনতে হবে। তা না হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এখান থেকে কোনো সুবিধা পাবে না। আর স্বাস্থ্যব্যয় সম্বন্ধে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র অবজারেশন আছে, যে আমাদের দেশে দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দের অপচয় হয়।

বর্তমান বাজেটে যে সীমিত টাকা আছে, তা বাড়ানোর দরকার আছে। তা না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার যে টার্গেট আছে তা আমরা পূরণ করতে পারবো না। তিনি বলেন, দরিদ্র এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু করতে হবে। আর যাই বরাদ্দ থাকুক না কেন, তা চলে যায় আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজনের বেতন এবং যন্ত্রপাতি ক্রয় ও নির্মাণ খাতে। তবে যন্ত্রপাতি ক্রয় ও নির্মাণ এই দুই জায়গায় দুর্নীতি বেশি হয়। দুর্নীতি কমাতে এই জায়গায় বরাদ্দ কমিয়ে স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি উপজেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কার্যকর করে এই বাজেটটাকে উপজেলাভিত্তিক যদি বণ্টন করা হয় তাহলে দেশের অধিকাংশ মানুষ উপকৃত হবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব ইত্তেফাককে বলেন, স্বাস্থ্যখাতে যে বাজেট দিয়েছে এটা গতানুগতিক। জনগণের পকেট থেকেই স্বাস্থ্যখাতে বেশি খরচ হয়। সেটা এখন হয়তো আরো বেশি হবে। বাজেট থেকে দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তদের যে সুবিধা পাওয়ার কথা তা পাবে না। দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হবে, মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্তের পর্যায়ে নেমে যাবে। আরেক কথায় বলা যেতে পারে— স্বাস্থ্যখাতে রাষ্ট্রের কোনো মনোযোগেই নেই। তারা চিকিত্সার ব্যাপারে অনেক কথাই বলেন, কিন্তু জনগণের চিকিত্সা ব্যবস্থাতে এটা কোনো ভূমিকাই রাখছে না। চিকিত্সা ব্যয় বেড়েই চলেছে। এর প্রভাব পড়ে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর।